দিব্যেন্দু দাস (বাসিন্দা,কামারকিতা ,পূর্ব বর্ধমান )
----------------------------------------
কৃষ্ণদাস পাল। উত্তর কলকাতায় শ্যামপুকুর স্ট্রীটের ছোট্ট এক চিলতে ঘরে; মা, বাবা, ভাই বোনদের সংসারে টিনের চালের রান্না ঘরে পড়াশুনা করে; সাফল্যের শিখরে পৌঁছানোর এ এক অনন্য কাহিনী। বড়বাজারের এক মামুলি ডিস্ট্রিবিউটর কে ডি পালের; সারা দেশ জুড়ে বিস্ক ফার্ম সাম্রাজ্য গড়ে তোলার; এ এক অনন্য ইতিহাস। পাশাপাশি নিজের গ্রামে সমস্ত রাস্তা কংক্রীটে ঢালাই করিয়ে; তাতে বাতিস্তম্ভ লাগিয়ে বিদ্যূতের যাবতীয় খরচ বহনের; এক অনন্য মানসিকতা। কৃষ্ণদাস পালের বিস্কফার্ম বুঝিয়ে দিয়েছে; বাঙালিও ব্যবসা শেখাতে পারে। কে ডি পাল বলেই সকলে চেনে তাঁকে। কিন্তু নাম তাঁর কৃষ্ণদাস পাল। ১৯৪০ সাল; বর্ধমান জেলার কামারকিতা গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবার নাম পূর্ণ চন্দ্র পাল; জননী অপর্ণা। পাঁচ ভাই; তিন বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। কামারিতার প্রাথমিক বিদ্যালয়েই তাঁর বিদ্যারম্ভ। বাবা বিয়ের আংটি বিক্রি করে; কলকাতায় এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। শহরে পৌঁছে গঙ্গায় ডুব দিয়ে প্রার্থনা করেন; ‘যাই করি তাতেই যেন সেরা হতে পারি’। শুরুতে অল্প মাইনের একটা চাকরী পেয়েছিলেন; কলকাতার এক বেসরকারী অফিসে। তারপর সেটা ছেড়ে বড়বাজারের একটা ছোট্ট ঘর থেকে শুরু হল; পূর্ণচন্দ্রের ট্রেডিং ও ডিস্ট্রিবিউশনের কাজ। স্বাধীন ব্যবসা কিন্তু অতি সামান্য। পরিবারের সকলকে নিয়ে এসে তুললেন; শ্যামপুকুরের এক ঘরের এক আস্তানায়। কৃষ্ণদাস ভর্তি হলেন কাছেই শ্যামবাজার এ. ভি স্কুলে। পড়াশুনার জায়গার অভাব; তাই তিনি পড়াশুনা করতেন রান্নাঘরে। অল্প বয়স থেকে ব্যবসার কাজে বাবাকে সাহায্য করতেন কৃষ্ণদাস। প্রথমে সাইকেল ভ্যানে; এ্যালপাইন দুধ পৌঁছে দিতেন বাড়ি বাড়ি। আরও বড় হলে; মোটর ভ্যানে বড় বড় দোকানে; নানান ধরনের মাল পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। এদিকে আবার সেল্স ট্যাক্স রেজিস্টার; লেখার দায়িত্বও ছিল তাঁর উপর। পড়াশুনাতে ও ভালো বলে নাম হয়েছে স্কুলে। তাই ছোট ভাই বোনেদের লেখাপড়ায়; সাহায্য করার দায়িত্বও ছিল তাঁর কাঁধে। এই করতে করতেই; এ. ভি স্কুল ছাড়িয়ে ইংরাজী অনার্স পড়তে ঢুকলেন সিটি কলেজে। বিএ করার পর এমএ ও তারপর আইন পড়া শুরু হল; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু এম.এ পরীক্ষার পর পূর্ণচন্দ্র আর অপেক্ষা না করে; ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলেন অজিত পাঁজার এক আত্মীয় কন্যা মঞ্জুশ্রীর সঙ্গে। তাঁর ব্যবসার অবস্থা ততদিনে বেশ পোক্ত হয়ে উঠেছে। শ্যামপুকুর স্ট্রীটেই দেড় কাঠা জমির উপর; ছোট্ট একটা বাড়ি করেছেন। তবু বাবার উপর চাপ না বাড়িয়ে; কৃষ্ণদাস চাকরী নিলেন হাওড়ার অক্ষয় শিক্ষায়তন স্কুলে। ইতিমধ্যে এমএ ও আইন; দুটি পরীক্ষারই রেজাল্ট বেড়িয়েছে। দুটোতেই কৃতকার্য। মন চাইল ওকালতি করতে। তাই কিছুদিন হাইকোর্টে; ওকালতিও করেন। ততদিনে পূর্ণচন্দ্রের ব্যবসা আরও বড় হয়েছে। তিনি ছেলেকে পুরোপুরি টেনে নিলেন; ব্যবসার কাজে। ১৯৭৩ সালে পূর্ণচন্দ্র তাঁর সমস্ত ব্যবসা; ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। ৭৪ সালে ছেলেরা সব লেগে পড়লেন; যে যার নিজের ব্যবসায়। কৃষ্ণদাস পেয়েছিলেন ডিস্ট্রিবিউশন। তিনটে মোটে কোম্পানী। নেসলে, ল্যাকমে আর ক্যালকাটা কেমিক্যালস। মাসে ব্যবসা হয় তিন লাখ টাকার মত। লাভ মাসে হাজার তিনেক টাকার মত। তাতেই চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু কে ডি লেগে পড়লেন ব্যবসা বাড়াতে। ডিস্ট্রিবিউশন নিলেন ব্রিটানিয়া, ডাবর, হরলিক্স, প্রভৃতি কোম্পানীর। ব্যবসা হু হু করে বাড়তে লাগল।
২০০০ সালে তিনি তৈরী করলেন; ‘বিস্ক ফার্ম বিস্কুট’ তৈরীর কোম্পানী; “সাজ ফুড প্রোডাক্টস প্রাইভেট লিমিটেড”। তার তিন ছেলে মেয়ে শর্মিষ্ঠা, অর্পণা জয়িতার নামের আদ্যক্ষর দিয়ে; রাখা হল এই নতুন কোম্পানীর নাম। প্রথম ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসাবে; কোম্পানীর হাল ধরলেন কৃষ্ণদাসের বড় জামাই বিজয় সিং। তখন ব্রিট্যানিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট (টেকনীক্যাল) পদ থেকে; সদ্য অবসর নিয়েছেন শ্রী অরূপ গুহ। তাঁকেও যুক্ত করা হল; বিস্ক ফার্মের সঙ্গে।
প্রথমেই ঠিক হয়েছিল; বিস্ক ফার্ম যে সব জিনিস তৈরী করবে; সে গুলি হবে বাজার থেকে আলাদা। প্রথম কারখানা হল; উলূবেড়িয়ার ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ পার্ক’ এ। এরপর শিলিগুড়ির ‘জলপাইগুড়ি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির’ ফুডপার্কে; ৮ একর জমির ওপর তৈরী হল আরও দুটি ইউনিট। ২০০৯ সাল থেকে ‘জাস্ট বেকড’ নামে; খুচরো দোকানও চালু হল। বর্তমানে ৪০ টির বেশি জাস্ট বেকড চালু আছে। এটাকে ১০০ তে নিয়ে যাওয়া। সমস্ত ব্যবসাকে নিয়ে আসা হয়েছে; কৃষ্ণদাসের মা অপর্ণার নামের ছাতার তলায়। দুটো অংশ ট্রেডিং আর ম্যানূফ্যাকচারিং। এর মধ্যে ট্রৈডিং থেকে ব্যবসা হয় বছরে; ৭০০ কোটি টাকা। আর ম্যানুফ্যাকচারিং অর্থাৎ বিস্ক ফার্মের বিস্কুট, কুকিজ, কেক, ওয়েফার প্রভৃতি ফুড প্রোডাক্ট ব্যবসা দেয়; বছরে ১০০০ কোটি টাকার উপর। এ ছাড়া শিলিগুড়িতে একটা প্যাকেজিং ইউনিট খোলা হয়েছে; যার বাৎসরিক ব্যবসা বর্তমানে বছরে ৫০ কোটি টাকার উপর। বেকারি ব্যবসায় বিস্ক ফার্মের স্থান এখন চতুর্থ। প্রথম স্থান দখল করাই কৃষ্ণদাসের লক্ষ্য। তবে একটা কথা ব্রিট্যানিয়া; পার্শে যেমন দেশের সব জায়গায় পাওয়া যায়, বিস্ক ফার্ম পাওয়া যায় না। যাতে ভারতের সর্বত্র পাওয়া যায়; সেই লক্ষ্যে নাগপুরে একটা কারখানা খোলা হয়েছে। পরের লক্ষ্য বেঙ্গালুরু। সেখানে কনকপুরায়; ৮ একর জমি কেনা হয়েছে। শীঘ্রই কারখানা তৈরী শুরু হবে। এই কারখানায় উৎপাদন শুরু হলেই; ভারতের সর্বত্র পাওয়া যাবে বাঙ্গালীর বিস্ক ফার্ম; ব্রিট্যানিয়াকে হারিয়ে প্রথম স্থান অধিকারই যার লক্ষ্য।এছাড়া ও কামারকিতা র জন্য পুরো গ্রাম ঢালাই রাস্তা, সারা গ্রামে আলোক বাতি , ছাত্র ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান, বিদ্যালয়ের উন্নয়ন, খেলার মাঠ ও টুর্নামেন্ট ক্রিকেট ও ফুটবল, রামকৃষ্ণ মিশন, দাতব্য চিকিৎসালয়, কম্পিউটার সেন্টার , পিকনিক স্পট, গ্রামের সকল মন্দিরের রূপকার, শ্মশান ঘাট নির্মান, পানীয় জল সরবরাহ , রক্ষাকালী মন্দির নব রূপে নির্মান, রাধাগোবিন্দ মন্দির সংস্কার, পুকুর ঘাট নির্মান, খেলার সামগ্রী বিতরণ ইত্যাদি ।